স্বাগতম। আপনি এই ব্লগের counter তম পাঠক

২ জুল, ২০১০

বাদাম লিখেছেন আনোয়ার পারভেজ শিশির


আমাদের দোতলা বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা বড় বাজারের দিকে চলে গেছে, ভোরবেলা থেকেই সেই রাস্তা, সাইকেল আর রিকশার চলাচলে মুখরিত হতে শুরু করে। শৈশব থেকেই এই দুটি যানবাহনের সাথে পরিচিতি কিন্তু প্রথম যেদিন গ্রাম্য এক তরকারী বিক্রেতাকে মাডগার্ডবিহীন সাইকেলের ক্যারিয়ারের দুপাশে দুটো বড় বড় ঝুড়িতে তরকারী বয়ে নিয়ে যেতে দেখলাম সেদিন তো আমি হেসেই খুন। সত্যিই কি তার সাইকেল চালানোর কায়দা, একবার বামে একবার ডানে দুলে, দুপায়ের পাতা ছড়িয়ে! রিকশাওয়ালা, কেউ হুড ফেলে কেউ তুলে, রডে চড়ে কিংবা সিটে বসে যাত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছে। বারান্দা থেকে প্রতিদিন এই সমস্ত দৃশ্যগুলো সশব্দ চলচ্চিত্র মনে হত যা শুধু সামনেই নয়, এপাশে ওপাশে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যেত।

দাদার অন্তর্ধানের পর আমাদের সাংসারিক সূত্রচ্ছেদ হলো, সম্পত্তি ভাগাভাগিও হলো যথারীতি; কিছুকালের ব্যবধানেই একটা ফলবান বৃক্ষ যেন শুধু জ্বালানী কাঠের উৎস হয়ে রইলো। আমার মেজোচাচা আমাদের পরিবারের একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি বেশ ভয় পেতাম আর যাকে ভয়ই পেতাম না - আমার ছোটচাচা, বিদেশে গিয়ে আর দেশে আসার নাম করলো না। একটা ছোটদের সাইকেলের খুব শখ ছিল, কিন্তু বাবাকে কোনোদিন বলা হয়নি, পরিস্থিতিও ছিল না; অগত্যা, মেজোচাচার ব্রিটিশ আমলের আট হাত লম্বা ফ্লাইং পিজিয়্যন সাইকেলটি দুপুর পড়ে এলে যখনি আমি নিয়ে বাইরে বের হবো তখন তার অগ্নিদৃষ্টিতে ভস্ম হয়ে যেতাম প্রায় প্রায়ই। শিকার ও শিকারী দুপক্ষেরই ব্যর্থতা ও সফলতা সব সময় থাকে তেমন যেদিন সাইকেল নিয়ে বাড়ির বাইরে একবার যেতে পেরেছি সেদিন আমার ঈদ। সাইকেলের খোল থেকে রডে, রড থেকে সিটে চালানো শিখতে এমন বেশকিছু সর্ব্বনাশ ও পৌষ মাস পেরোতে হলো।

দুপুরবেলা একেবারে বাঁধাধরা নিয়মে শুখনো শরীরের এক বাদামওয়ালা আমাদের রাস্তা দিয়ে হেটে যেতো আর যেতে যেতে যেভাবে সে “ওই বাদা…ম……বাদাম” বলে ডেকে যেতো তেমন করে আর কাউকে ডাকতে শুনিনি কখনো। একটা ব্যাপার খেয়াল করতাম, বাদামওয়ালার পায়ে কোনোদিন স্যান্ডেল দেখিনি, যত কাঠ-ফাঁটা রোদই হোক না কেন কিংবা বেদম বৃষ্টি, তবে তার জামার কলারে পীঠ বরাবর ঝুলে থাকতো একটা শিক বের হওয়া ছেঁড়া ছাতি। আমরা বাদাম কেনার সময় তাকে অনেকবার বলেছি একটা স্যান্ডেল কিনতে কিন্তু তার নাকি স্যান্ডেল পায়ে দিলে পা চুলকায়! কত রকম এলার্জি যে মানুষের আছে!!

বাড়ির কাছেই মোড়ে বাবার অনাড়ম্বর হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানা। বাবাকে দেখতাম প্রায় সময়ই হয় মেটিরিয়া মেডিকার পাতা ওল্টাতে কিংবা হোমিওপ্যাথির অনুবিক্ষণীক শিশিগুলো নাড়াচাড়া করতে। রোগীর চেয়ে তার সমবয়সীদের আনাগোনা চোখে পড়তো বেশী; তাদের সাথে মাছধরা আর পাখি শিকার বিষয়ক প্রসংগে আলাপরত থাকতে দেখতাম। আমি যখনই সময় পেতাম, মা’র তরকারী কোটা, শিলের পাটায় মসলা বাটা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম আর ইচ্ছে হলে ডাক্তারখানায় গিয়ে বাবার হোমিওপ্যাথির গুড়ি গুড়ি মিষ্টি ওষুধ খেয়ে আসতাম।

আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যেতাম দুপুরে। একদিন পর একদিন পড়া থাকতো কিন্তু সাধারনত আমি দুপুরে খেয়ে পড়তে যেতে পারতাম না। পরিচারিকাবর্জিত মধ্যবিত্ত সংসারে দুইবেলা খাবারের একবেলা রান্না উঠাতে মা’র বেলা গড়িয়ে যেতো। মা’র তরকারী কোটায় হাত লাগাতে চাইলেই বকুনি, “তুই পারবিনে, জ্বালাসনে এখন, যা এখান থেকে” বাবা দুপুরবেলা বাড়িতে এসে কোনোদিন রান্না তৈরী পেতো, কোনোদিন পেতো না। তবে এ নিয়ে কখনো বাড়ী মাথায় করতে দেখিনি তাকে। তবে তার ম্লান মুখখানি আমার চোখ এড়াতো না কিন্তু মেজোচাচাকে দেখেছি রান্না দেরী হলেই চাচীকে অনেক ঝাঁল ঝাঁল কথা শোনাতে।

মা’র খুব শুঁচিবায়; পরিপাটি করে মাছ, তরি-তরকারী কাটা-ধোয়া, মসলা-বাটা এবং শিলের পাটা ধুয়ে পিঁয়েজ-রসুন-সর্ষে-জিরের সর্বশেষ নির্যাসটুকু তরকারীতে না দিতে পারলে তার শান্তি হতো না, আর একা একা এই শিল্প-মনের বিকাশ ঘটাতে গিয়ে মা রান্নায় দেরী করে ফেলতো শুধু। রান্নাবান্নায় আমার সম্পৃক্ততা মা পছন্দ না করলেও আমি যেদিন ধইনেপাতা, তেলে ভাঁজা শুখনো-মরিচ আর সর্ষের তেল দিয়ে আলু ভর্তা মাখাতাম সেদিন মা’র হাতের পাতলা মুষড়ির ডাল দিয়ে ভাত মেখে একটা কাঁচা মরিচ ভাঁঙ্গতে ভাঁঙ্গতে আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বলতো “দারুন হয়েছে রে!”।

গ্র্যাজুয়েশ্যন করার পর ব্যাংক-বৃত্তি পেয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাওয়া গেলো। বলতে গেলে কোনো খরচ ছাড়াই পড়াশোনার এই সুবর্ণ প্রাপ্তিতে বাঁধ সাধলো না কেউ, শুধু মা ছাড়া; তার যুক্তিসঙ্গত দুঃচিন্তা, “তোকে রান্নাবান্না করে দেবে কে? না খেয়ে মরবি তো!” বাবার মুখ বিজয়োজ্জ্বল, “তোর প্লেনের টিকেটের ব্যবস্থা হলো আজ”; মা'র কাছে থেকে দেড়মাস রান্নার যে তালিম নিয়েছিলাম, তার সবটুকু কাজে লাগালাম বিদেশে এসে; মা’র চেয়ে বরং ক্ষেত্রবিশেষে রান্না ভালোই হয়, নাকি জিহ্বের ভুল বলতে পারিনে।

নুতন ভৌগোলিক পরিবেশে ক্রমান্বয়ে বছরের কাটা ঘুরতে লাগলো, আমার পড়াশোনা শেষে চাকরি হলো। দেশে বেড়াতে গিয়ে বাবার সাথে শেষবার রোজার ঈদের নামায পড়লাম। তারপর আর দেশের মাটি স্পর্শ করার সুযোগ হয়নি, বোধ করি সাহস হয়নি। মা’র কাছে এখনো শুনি বাবার শেষ দিনগুলোর কথা, পিতৃসূত্রে পাওয়া তার প্রিয় সোনার পকেট-ঘড়িটা হারিয়ে যাওয়ার কথা, তার হঠাৎ সুদূরযাত্রার কথা; মনে আছে, আঁধার-দৃষ্টির তাৎক্ষণিকতায় প্রলাপের মতো বলেছিলাম, “বাবা…যাত্রা শুভ হোক”… .. .

দুপুরবেলায় বাদাম খাওয়ার পুরোনো অভ্যেসটা আজও থেকে গেছে; সকালে কাজে আসার সময় প্রায়শঃই বাদাম কিনে আনি, টুকটাক চিবোই কাজের ফাঁকে। ইদানিং লক্ষ্য করছি, বাদাম খেলে দেরীতে ক্ষিধে লাগে, আর আজকে চোখের সামনে খুব ভাঁসছে একটা নিয়ত-দৃশ্য - আমার বাবা তার হোমিওপ্যাথির চেম্বারে বসে ভরদুপুরে বাদাম চিবোচ্ছে, তাকে দেখতে দেখতে আমি প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যাচ্ছি আর চিন্তা করছি কখন যে আমার পড়া শেষ হবে!…


শেয়ার করুন

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More